বাংলাদেশের চিত্রকলার জগতে পরম শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীর এক কিংবদন্তী ও শিল্পাঙ্গনের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। তাঁর প্রধানতম পরিচয়, তিনি চিত্রশিল্পী তৈলচিত্রের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত। জলরং, রেখাচিত্র, এচিং, লিথোগ্রাফও করেছেন। ম্যুরালও তাঁর প্রিয় মাধ্যম। চিত্রশিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি থাকলেও সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর সহজ বিচরণ। গল্প, উপন্যাস ও কবিতা রচনা করেছেন। তিনি একজন মুদ্রাতত্ত্বববিশারদ। মৌলিক চিন্তায় ইতিহাস-গবেষণায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, সহকারি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। চিত্রশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। তাঁর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখালেখি হয়েছে প্রচুর, দিয়েছেন অজস্র সাক্ষাৎকার। তাঁকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন।
তিনি বলতেন, জীবিত অবস্থায় কি পেলাম, এটা বড় কথা নয়। মৃত্যুকে অতিক্রম করে টিকে থাকা গেলো কি না, সেটাই বড় কথা। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন বিরান শুষ্ক মাঠে পানির অন্বেষায় মাটি খুঁড়ে, তেমন করেই শিল্পশৈলীর অন্বেষায় বহু দুর্গম পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন। সৃষ্টির মাধ্যমে, কর্মের মাধ্যমে মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। গত বছর ১৫ই আগস্ট এ মহান ব্যক্তিত্ব ৮৮ বছর বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুর পর পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম হওয়ার কথা বলতেন। শেষ পর্যন্ত, তা-ই হলো। তিনি বহুমুখী প্রতিভার এক দীপশিখা। মহাকালে তাঁর স্থান অনন্য হয়ে থাকবে। সময়ই বিচার করবে তাঁর শিল্পনৈপুণ্য। তিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন। মৃত্যুঞ্জয়ী যথার্থই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
জন্ম তাঁর ১৯৩২ সালের ১৭ই আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বাবা জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নাম রেখেছিলেন আবু’ল খার্য় মুর্তজা বশীরুল্লাহ্। বাবার পরিচয়ে শৈশবে তিনি ছিলেন গর্বিত, অহংকারি ও উদ্ধত। যদিও পরবর্তী সময়ে শিল্পী জীবনে এসে নামের শেষে ‘উল্লাহ্’ নাম মুছে দিলেন। পিতার পরিচয়ের আড়ালে না থেকে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইলেন। সফলও হয়েছিলেন শতভাগ। পিতার মৃত্যুর পর বেদনার্ত হৃদয়ে তিনি বললেন, আমি মুর্তজা বশীর, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র পুত্র। কোনো কুন্ঠা আজ এতে নেই।
ছোটবেলায় মা মরগুবা খাতুনকে ঘিরেই ছিল তাঁর জগৎ। মা ডেকে বলতেন, দেখ্ আকাশের দিকে, দেখেছিস্ গরুর পাল যাচ্ছে। তিনি খুঁজে পেতেন না। তখন মা বলতেন, দেখ্ না ওই যে গরু, তখন তাঁর সত্যি মনে হতো যে, গরুর পালই যাচ্ছে। মূলত ছোটবেলাতেই মা তাঁর ভেতরে কল্পনাশক্তি বুনে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ছবি আঁকতে গিয়ে পলেস্তারা খসে পড়া, লালচে ইট বের করা, ফাটল ধরা দেয়ালে তাকিয়ে তিনি ফর্ম আবিষ্কার করলেন। এভাবেই বিমূর্ত কিছুর ভেতরে মূর্ত রূপের সন্ধান পেলেন, যা মায়ের কাছ থেকেই শেখা বলে তিনি মনে করেন।
বাড়িতে জ্ঞানপিপাসু পন্ডিত পিতার বৃহৎ এক ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। শৈশব ও কৈশোরে এই পাঠাগারের প্রতি তিনি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতেন। বই ছাড়াও এই পাঠাগারে ছিল এনসাইক্লোপিডিয়ার ভল্যুম, মডার্ন রিভিউ, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বিচিত্রাÑ এসব সচিত্র প্রকাশনা। সুযোগ পেলেই পাঠাগারে গিয়ে ছবি দেখার জন্য বইপত্র খুলে দেখতেন। ছবির রং ও রেখা দেখে মুগ্ধ হতেন। ছবিগুলো কেটে কেটে তিনি একটি স্ক্র্যাপ বুক করেছিলেন। অটোগ্রাফ পাওয়ার জন্য খ্যাতিমানদের চিঠি লিখতেন। অন্যদিকে, পিতার কাছে আসা চিঠিগুলোর ডাকটিকিট দেখতেন। অনেকসময় ছিড়েও নিতেন। সেসময় দেখেছেন পিতার কাছে আসা রবীন্দ্রনাথের চিঠি। আরো দেখেছেন দীনেশ চন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, সুকুমার সেনের চিঠি, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মোহিতলাল মজুমদারের উপহার দেয়া বই। তখন মনে আকাক্সক্ষা হতো, পিতার মতো বিখ্যাত হওয়ার।
মুর্তজা বশীরকে ১৯৩৯ সালে সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করানো হয়েছিল নবকুমার হাই স্কুলে। এর আগে বাড়িতেই পড়ালেখা করতেন মা ও প্রাইভেট টিউটর পড়াতেন। ক্লাস টুতে ভর্তি করানোর জন্য নেয়া হলেও সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়াতে স্কুল কর্তৃপক্ষ সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে নেয়। স্কুলজীবনে তিনি ড্রইং করতে পারতেন না। ক্লাসে ড্রইং ছিল এবং তাতে তিনি শূন্য পেয়েছিলেন। কিন্তু রং লাগাতে তাঁর ভালো লাগতো। ছবি দেখতে ভালো লাগতো। শিল্পী হবেন, এটা কখনো ভাবেননি। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কিছুসময় বগুড়া আযিযুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেসময় মুর্তজা বশীরকে বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। যদিও পরবর্তীতে আবার ঢাকায় ফেরত আসেন। ১৯৪৭ সালে তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, তখন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
বড় ভাইয়েরাও বাম রাজনীতি ঘেঁষা ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির জন্য তিনি গ্রাফ করে কার্ল মার্কস, লেনিনের ছবি আঁকতেন। সে সময় ১৯৪৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন তাঁকে শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর ফুটিয়ে তুলতে পরামর্শ দেন। এটি তাঁর কিশোর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। একবার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন লক্ষেণীতে। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বাবা শহীদুল্লাহ্ সাহেব তাঁকে বললেন, ইউ আর মাই সান। ডোন্ট বি মিডিওকার, আইদার নটোরিয়াস অর ফেমাস। এ কথা তাঁর জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট।
মেট্রিক পরীক্ষার পর কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় হাজং বিদ্রোহ চলাকালে নিজের আঁকা ছিঁড়ে যাওয়া পোস্টার জোড়া লাগাতে গিয়ে তিনি পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। নির্যাতনও ভোগ করেন। কারাগারে তিনি ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। ক্লাস টেনে পড়ার সময় এক রাতের মধ্যে তিনি একটি নাটক লিখে ফেলেন, যদিও ওটা মঞ্চস্থ হয়নি। মায়ের আবদনের প্রেক্ষিতে চার মাস পর তাঁর জামিন হয়। সাহিত্যের প্রতি তাঁর দুর্বলতা সবসময়ই ছিল। এ সময় সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আসে তাঁর। ছবি আঁকার প্রতি একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে তিনি এক ক্লাস সিনিয়র শিল্পী আমিনুল ইসলামের সাহচর্যে ছবি আঁকায় উৎসাহ ফিরে পান। শিল্পীগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের উৎসাহে ও সিনিয়র বন্ধু আমিনুল ইসলামের শেখানো কৌশলে তিনি তেল রং-এ কাজ করতে থাকলেন। জয়নুল আবেদিন আঁকার সময় হাতকে সোজা রাখতে বলতেন। কখনোই ভাঁজ করতে দিতেন না। শিল্পাচার্যের শেখানো ভঙ্গিতে বশীর ছবি এঁকেছেন আজীবন।
১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্পশিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ বেশ ক’জন গুণী শিল্পীকে। প্রথম থেকেই বশীর সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে তাঁর চিত্রকলার বিষয়স্তু করেছিলেন। শিল্পী জীবনের সূচনা থেকেই মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও মমতা ছিল প্রগাঢ়। পরবর্তী সময়ে তিনি বিমূর্ত ও আধাবিমূর্ত ধারায় অগ্রসর হলেও ছবির পেছনে সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা অটুট ছিল।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রæয়ারি গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে আরও অন্যান্য সহযোদ্ধার সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় লিনোকাট মাধ্যমে ‘রক্তাক্ত একুশে’ শিরোনামে চিত্রটি আঁকেন তিনি। ১৯৫৪ সালে আর্ট কলেজের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। বশীর এখানে ব্যাপকভাবে পাশ্চাত্য শিল্পের ইতিহাস, ভারতের শিল্পের ইতিহাস, শিল্পের তত্ত¡ ও নান্দনিকতা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পান। এখানে তিনি অর্দ্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, মিউজিয়াম কিউরেটর দেবীপ্রসাদ ঘোষ, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে পান। এ সময় পরিতোষ সেনের ছবি ও আঁকার কৌশল সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়, যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। কলকাতায় চার-পাঁচ মাসের প্রবাসজীবনের সময় তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন। সেটিই ১৯৭৯ সালে ‘আল্ট্রাামেরিন’ নামে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি তাঁর জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা কি-না এ নিয়ে অনেকবার জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হলেও তিনি কখনো এ বিষয়ে মুখ খুলেননি, রহস্যের ভেতরে রেখেছেন।
আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর ১৯৫৪ সালে বছরখানেক নবাবপুর সরকারি হাই স্কুলে ড্রইং শি¶ক হিসেবে ছিলেন। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শি¶ার জন্য বাবার আর্থিক সহযোগিতায় ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। একাডেমিয়া দা বেল্লে আর্তিতে তিনি দুই বছর শিক্ষাগ্রহণ করেন। এ সময় প্রাক- রেনেসাঁসের শিল্পী দুচ্চো, সিমাব্যু, জত্তো, সিমন মার্তিনি, ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো প্রমুখের ছবিতে ড্রইংয়ের সরলীকরণ, সীমিত রং ও তথাকথিত আলো-ছায়াহীনতা এবং অবয়বের ঋজুতা তাঁকে ভবিষ্যত রচনাশৈলীর দিকনির্দেশনা দেয়। এ সময় অধ্যাপক কাপুচিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও নূন্যতম রঙ ব্যবহারের শৈলী বশীরকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে বশীর পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকের্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য এঁকেছেন তিনি।
ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ১৯৫৮ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারিতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা তৈলচিত্র ছিল। লন্ডনে ছয় মাস থেকে দেশে ফেরার পর ঢাকায় চাকরি না পাওয়ায় ভাগ্যেন্বেষণে করাচি যান তিনি। এই সময়ে তাঁর আঁকা ছবিগুলোর বিষয় ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন। ব্যতিক্রম ছিল শুধু স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার ‘স্বপ্নচারীর গাঁথা’ কবিতায় প্রথম পংক্তি নিয়ে একটি ছবি। ১৯৫৯-এর মে মাসে করাচিতে ফ্লোরেন্স ও করাচিতে আঁকা বশীরের ২৪টি ছবি নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা উপস্থিত ছিলেন। করাচিতে এটি ছিল কোন বাঙালি শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী। সেই সময় তাঁর কাজ শিল্পী ও শিল্প সমঝদারদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়েছিল।
এরপর ১৯৬১ সালে লাহোরের একক প্রদর্শনীতে ছবির বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল পাখি হাতে রমণী, খাঁচায় পাখি বা রূগ্ন শিশু ও খাঁচাবন্দি পাখি ইত্যাদি। ১৯৬২ সালে তিনি আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীর মুখোমুখি বসে চা পানের সময় তাঁর মনে হলো জীবনটা গোছানো এবং প্রতিটি বস্তু সুশৃক্সখল কাঠামোয় আবদ্ধ। এই ভাবনা থেকে চেহারা, গাছ, বাড়ি, মুরগি সবকিছু স্থাপত্যিক কাঠামোয় জ্যামিতিক বন্ধনে গেঁথে গেল। বিবাহিত জীবনের প্রভাব থেকে এই ধরনের ছবি আঁকলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল অবধি। এ সময় বিয়ের আমেজ নিয়ে ক্যানভাসে স্থান পায় সোনালি ও রূপালি রং, যা তিনি এর আগে ছবি আঁকতে ব্যবহার করেননি।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকারের ফলস্বরুপ সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি আঁকার কোনো তাগিদ তিনি অনুভব করেননি। সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি একজন শিল্পীর মনোজগৎ, তার চিন্তা-ভাবনা, তার আনন্দ, সেখানে যা সে সৃষ্টি করে। যেহেতু সমাজের প্রতি অঙ্গীকার অনুভব করতেন, বিমূর্ত চিত্রকলা ভাল লাগলেও বিমূর্ত চিত্রকলা আঁকার জন্য তিনি কোন তাগিদ বোধ করেননি। ষাটের দশকের শুরু থেকে যখন দেখলেন তাঁর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া প্রমুখ এরা সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি আঁকছেন, কিন্তু নিজে আঁকছেন না। তখনও তিনি সেমি ফিগারেটিভ ছবি যা মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে আঁকতেন। নিজের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করলো, তিনি বোধ হয় তাঁদের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। কিন্তু, সোসাইটির প্রতি কমিটমেন্ট থাকার কারণে বিমূর্ত ছবি আঁকার ইচ্ছা হলেও আঁকছেন না। তখন দেশে রাজনৈতিক অবস্থা হল এক প্রকারের দমবন্ধ অবস্থা, আইয়ুব খানের মার্শাল ল এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক কারণে জটিলতা; স্বামী স্ত্রীকে বুঝছে না, পুত্র পিতাকে বুঝছে না, মানে কোথায় যেন যোগাযোগ আদান-প্রদানে ব্যাঘাত ঘটছে। তখন তাঁর কাছে মনে হল যে, মানুষ একটা অদৃশ্য প্রাচীরের ভেতরে বন্দী, যার ফলে কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে পারছে না। খুব অস্থির হয়ে গেলেন যে কী করবেন? তখন তিনি বেগম বাজারে থাকতেন পিতার বাসায়। রিকশা করে যাওয়ার সময় ওই জেলখানার প্রাচীর দেখতেন। জেলখানার প্রাচীরে কখনো দেখেন অনেক জায়গায় পলেস্তরা খসে গেছে, কখনো ইট বেরিয়ে গেছে, কখনো হয়ত কোনো রাস্তার ছেলে পেরেক দিয়ে আঁচর কেটেছে, হয়ত হাতে আলকাতরা মেখে দেয়ালে হাতের ছাপ লাগিয়েছে, হয়ত কোন পোস্টার অথবা বিজ্ঞাপন ছিল সেটা তুলে ফেলে দিয়েছে, ফলে আঁকা দাগ কিংবা টুকরো কাগজ লেগে রয়েছে এইগুলো তিনি দেখতেন। তখন তাঁর মনে হল যে, এই গুলোকে তিনি যদি আঁকেন, এর এপারেন্ট লুক হবে অ্যাবস্ট্রাকট, কিন্তু হান্ড্রেট পার্সেন্ট রিয়ালিজম। তিনি দেখলেন, যেভাবে নৈঃসর্গিক দৃশ্য আঁকছেন দেখে দেখে কিংবা একটা মানুষকে সামনে থেকে যেভাবে তিনি আঁকছেন, যদি তিনি ওই দেয়ালটা ওইভাবে আঁকেন, কিন্তু যেহেতু এখানে কোন অবয়ব নাই, এখানে নানা রকম টেকচার, ইমেজ। ফলে এইগুলো বিমূর্তভাবে ধরা দিবে। তখন তিনি ‘দ্যা ওয়াল’ বা ‘দেয়াল’ নামে একটি সিরিজ করেন। ‘দেয়াল’ সিরিজের সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে করাচিতে। এ প্রদর্শনীতে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। ১৯৬৮ সালে তাঁর একটি রেট্রোস্পেকটিভ আয়োজিত হয় ঢাকায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে।
১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে ফ্রান্সে চলে যান। বাংলাদেশ তখনও স্বাধীন হয়নি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘরে ঘরে সার্চ করে মানুষজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে তিনি চলে গেলেন এ জন্য যে তিনি বাঁচতে চেয়েছেন, মরতে চাননি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক মিছিলটি আয়োজনের নেতৃত্বদানকারীদের তিনি একজন। ফলে সহজ সরলভাবে মনে তাঁর অপরাধবোধ কাজ করছিল। টেলিভিশনে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখতেন আর অস্থিরবোধ করতেন।
প্যারিসে মোমোঁরসি নামে যে জায়গায় তিনি থাকতেন সেখানে দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোকে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। ফ্রান্সে বরফ পড়ার পরে যেন উঠান নোংরা না হয়, সে জন্য পাথরের ছোট ছোট নুড়ি বিছানো থাকত। হঠাৎ একদিন তাঁর জুতায় ধাক্কা লেগে একটা নুড়ি উল্টে গেল। তিনি নুড়ি পাথরটা তুললেন; দেখলেন যে, পাথরটা অনেক দিনের পুরনো। ক্ষয়ে যাওয়া পাথরে দেখলেন মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ডিসটর্টেড অর্গান। নুড়ি পাথরগুলো তিনি কুড়িয়ে নিলেন। তাঁর মনে পড়লো যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন কোন যোদ্ধা মারা যেত, তখন তার মাথার সামনে একটা পাথর রাখা হতো। সেই পাথর আ¶রিক অর্থে আর পাথর না, একটা প্রতীক হয়ে যেত। নুড়ি পাথরগুলো তিনি হুবহু আঁকলেন। যেমন করে টেবিলের ওপর বোতল, বই কিংবা কারো প্রতিকৃতি আঁকা হয়, ঠিক ওই ভাবেই, একজন রেনেসাঁস শিল্পীর দৃষ্টি থেকে, মানে হুবহুÑ নিখুঁত আঁকা; কিন্তু মানসিকতাটা নিলেন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো। নাম দিলেন ‘এপিটাফ ফর দ্যা মার্টারস’। এ সিরিজে সর্বমোট ছবি আঁকলেন ৩৭ টি।
বাংলাদেশে ফিরে এলেন ১৯৭৩ সালের জুনে। আগস্টের ১ তারিখে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। ১৯৭৬ সালে ‘এপিটাফ ফর দ্যা মার্টারস’ সিরিজটির প্রদর্শনী করলেন। এরপরই তিনি নতুন ধরনের ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে গেলেন। পিতা-মাতা নামাজ পড়তেন। ঘরে পবিত্র কোরআনের অনেক সুরা বাঁধানো দেখতেন। বেবিট্যাক্সি, বাসে এগুলো লেখা। এমন চিন্তাভাবনা থেকে জায়নামাজ, সোলেমানি নকশার ধারণা ও ডিজাইন নিয়ে ১৯৭৯ সালে আঁকলেন ‘জ্যোতি’ সিরিজ। সেখানে মিনিয়েচার চিত্রকলার মতো সোনালি ও রূপালি রং ব্যবহার করলেন। ইসলামি ক্যালিগ্রাফি সেখানে প্রধান ছিল না। মূল সুর ছিল জ্যামিতিক। তাবিজ আর জায়নামাজের বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে লিখলেন আল্লাহ-মোহাম্মদ।
১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে আঁকলেন বেশ কয়েকটি সিরিজ ‘বাতাস বয়’, ‘ঢেউ’, ‘ধ্বংস’, ‘বিস্ফোরণ’, ‘বাসনা’ ও ‘আবহমান’। এসব সিরিজের আরও বেশকিছু ছবির পরিবর্তিত রূপ নব্বই দশকেও দেখতে পাই। এখানে আমরা পাই বিমূর্ততা ও বিমূর্ত বাস্তবতার মেলবন্ধন। এখানে তিনি ফর্ম ভেঙেছেন, রঙের প্রয়োগ করেছেন সতর্ক ও সংযত হয়ে। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ধানমন্ডিতে তাঁর ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। তাঁর ভাইয়ের একটি গাড়ি ঠিক করার ওয়াকশর্প ছিল। সেখানে একটা গাড়ি দেখলেন রোজা (যেমন- নোয়া বা ভক্সি) নামে। গাড়িটি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। ওয়ার্কশপে যখন গাড়িটি ডেন্টিং করা হচ্ছিল তা দেখে তিনি ফটোগ্রাফ করলেন। সেগুলো তিনি একদম বিমূর্ত। সেই ফটোগ্রাফ দেখে তিনি কয়েকটি ছবি আঁকলেন।
১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ফেলোশিপে তিন মাসের জন্য লন্ডনে গিয়ে তিনি কালীঘাট ও পালযুগের চিত্রকলা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান। ১৯৯০ সালে বশীর আবার ফিরে এলেন ফিগারেটিভ ছবির জগতে। তবে অন্তরের প্রেরণায় অতটা নয়, যতটা বাইরের তাগিদে। আনোয়ারা বা সালেহার মতো এককালের খুব জনপ্রিয় উপন্যাসের নারী চরিত্রের রূপ দিলেন তিনি রঙে-রেখায়। আমাদের শিল্পকলার ঐতিহ্য, কালীঘাট, পালচিত্র ও পাশ্চাত্য শিল্পকলার একাডেমিক ড্রইংয়ের সংমিশ্রণে এ সময়ে তিনি অবয়বধর্মী চিত্র রচনা করেন।
একজন সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে এবং মার্কসবাদে বিশ্বাসী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন আগামীর দিন সুন্দর। কিন্তু পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যাচ্ছে মানুষ হতাশ, চারদিকে ধর্ষণ, হত্যা ও নেশাগ্রস্ত। তাই একজন সমাজ সচেতন শিল্পী হিসেবে তাঁর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো মানুষকে এই হতাশা থেকে মুক্তি দেওয়া। তখন তাঁর মাথায় এলো, প্রজাপতির জীবন খুব ক্ষণিকের, কিন্তু খুব ভাইব্রেন্ট, জীবন্ত, লাফাচ্ছে এবং তার ডানায় নানা রকম আলো। প্রজাপতির পাখায় তিনি খুঁজে পেলেন প্রাণের জোয়ার। প্রজাপতির পাখাগুলোকে তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে বড় করে দেখলেন। একটা পাখাকে কয়েক গুণ বড় করে তার রংগুলো বোঝার চেষ্টা করলেন। প্রজাপতির পাখায় যা আছে, তিনি হুবহু আঁকলেন। এই সিরিজের নাম দিলেন ‘দ্যা উইং’ বা ‘পাখা’।
১৯৯৯ সালে রঙের ব্যাকরণ মেনে তিনি ক্যানভাসে বর্ণালি রঙের চিত্র রচনা করেন। ‘ক্যানটোস’ বা ‘স্বর্গ’ সিরিজের এ চিত্রগুলো আঁকার পেছনে ছিল মানসিক প্রশান্তি। আকাশপথে আমেরিকা ভ্রমণকালে সূর্যান্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ের মেঘের বর্ণচ্ছটা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
২০০২ সালে রঙের ব্যাকরণ মেনে ৩৭ টি ছবি আঁকলেন ‘কলেমা তৈয়বা’ শীর্ষক চিত্রমালা। বাংলার সুলতানি আমলের শিলালিপি ও মুদ্রা থেকে তিনি অক্ষরগুলো গ্রহণ করলেন। স্পষ্ট করে বললেন, কালিঘাট ও পালযুগের শিল্পকলার মতো তুর্কি, হাবশি, আরব ও আফগান সুলতানদের স্থাপত্য, টেরাকোটায় উৎকীর্ণ জ্যামিতিক নকশা, শিলালিপিতে ও মুদ্রার অক্ষর বাংলার শিল্প ঐতিহ্য।
সারাজীবন ধরে বিভিন্ন মাধ্যমে চিত্রকর্ম আঁকার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পটভূমিতে আছে শিল্পী মুর্তজা বশীরের একটি বিশাল ম্যুরাল যার নাম ‘অক্ষয়বট’। যার অর্থ হলো অবিনশ্বর। শিল্পী ইট কেটে এই ম্যুরাল করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ইট কেটে করা একমাত্র ম্যুরাল এটি। ‘মা’ বাংলাদেশ ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই ফুলগুলো যেন এক একটি তারা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন সপ্তর্ষিমন্ডল। মাটি ফুঁরে একজন নিহতের প্রতিবাদী হাত। গাছের ডাল পালা হলো শহীদ নর-নারী। হিউম্যান ফিগারটি সিমেন্ট দিয়ে করা। এটি নির্মাণে এক বছর সময় লেগেছিল। নির্মাণের সময় শিল্পী রোদে পুড়েছেন বৃষ্টিতে ভিজেছেন। বাঁশের মাচায় উঠে শক্ত হাতে হাতুড়ি বাটাল নিয়ে কঠিন ইট ও ঝামা ইট কেটেছেন। দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে এমন একটি উপাদান পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার করে শিল্পী তাঁর চিন্তা ও প্রয়োগে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘টাকার ক্রমবিকাশ’ নামেও ম্যুরাল করেছেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ম্যুরাল হলো ‘মূর্ছনা’, ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘আমার দেশ’, ‘বীজ’ ও ‘বৃক্ষ’।
২০১৩ সালে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। গ্লাভস না পরে খালি হাতে ছবি আঁকতেন। তেলরঙে তাঁকে ছবি আঁকতে নিষেধ করলেন ডাক্তার। কারণ তেলরঙের গন্ধ ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। এরপরও ২০১৭ সালে ‘রিভিউ’ নামে একটি সিরিজ এবং ২০১৬ সালে ‘শিরোনামহীন’ নামে আরেকটি সিরিজে বশীর এঁকেছেন নারীর প্রতিকৃতি। ২০১৭ সালে রেখাচিত্রেও এঁকেছেন নারীর অনেক প্রতিকৃতি। রেখার ন্যূনতম ব্যবহার শিল্পীর অশেষ নৈপুণ্যেরই পরিচয় দেয়।
মুর্তজা বশীরের শক্তিশালী ড্রইং নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। সিঙ্গেল লাইনের ড্রইংয়ে তাঁর মতো দক্ষ শিল্পী কমই আছেন এ দেশে। ড্রইং সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ড্রইং দুই রকম হয়। কমার্শিয়াল আর ক্রিয়েটিভ। প্রথমটায় আছে যান্ত্রিকতা, দ্বিতীয়টায় আছে হৃদয়ের ছোঁয়া। আমি হৃদয়ের ছোঁয়া দিয়েই ড্রইং করেছি।
শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীর নিত্য অনুসন্ধানী ছিলেন। কিছু একটি খুঁজেছেন তিনি প্রতিনিয়ত। আদতে পাবলো পিকাসোই ছিল বশীরের গভীর বিস্ময়, ঈর্ষা, প্রেমÑ সবকিছু। তাইতো পিকাসোর মতোই বারবার বাঁক বদলেছেন। মুর্তজা বশীর শুরু থেকেই নিজেকে বারবার ভেঙেছেন। এজন্য তিনি কখনোই একটি নির্দিষ্ট স্টাইল বা শৈলীর মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলেননি। মুর্তজা বশীর চেনা জগত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন।
চিন্তা, দর্শন, জীবন, মৃত্যু, দুঃখ সবকিছু ছবি এঁকে দেখানো সম্ভব নয় বলেই লিখেছেনও প্রচুর। তাঁর প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে, ঢাকার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায়। ছোটগল্পে বরং বশীর অনেক সংহতির স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ কাঁচের পাখীর গান (১৯৬৯) যতটা সমাদৃত হওয়া উচিত ছিল, ততটা হয়নি। বশীর বলতেন, আনন্দ ছাড়া তিনি আঁকতে পারেন না, আর বেদনা ছাড়া লিখতে পারেন না। কথাটা হয়ত সর্বাংশে সত্য নয়। তবে তাঁর কবিতায় বেদনার প্রকাশ হয়েছে নানাভাবে। প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয় কলকাতার পরিচয় পত্রিকায় ১৯৫৩ সালে। বশীর বলতেন, তাঁর সাহিত্যকর্ম আত্মজৈবনিক। আমরা ধরে নিতে পারি, কথাসাহিত্যে বর্ণিত ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটেছে, নাহলে তিনি তা প্রত্যাশা করেছেন। তেমনি কবিতায় ব্যক্ত প্রেম যার উদ্দেশ্যে, তার একটা বাস্তব ভিত্তি আছে এবং নারী, সমাজ ও দেশ সম্পর্কে অভিব্যক্তি অনুভূতি বশীরের নিজের। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ত্রসরেণু’, তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ও ‘সাদায় এলিজি’। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আল্ট্রামেরীন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’/ ‘অমিত্রাক্ষর’। নির্বাচিত রচনার মধ্যে রয়েছে ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’ এবং ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’। এছাড়া ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অব দ্য নিউম্যাসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’য় প্রাক মুঘল যুগের মুদ্রার ওপর তাঁর বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত ছবি আঁকেননি বশীর। এ সময়টায় তাঁর বিচরণ চলচ্চিত্রের অঙ্গনে। হুমায়ুন কবিরের উপন্যাস ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন বশীর, চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত সিনেমার জগত তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি।
অল্প বয়স থেকে ডাকটিকিট ও মুদ্রা জমানো ছিল বশীরের শখ। তিনি যে একজন মুদ্রাতত্ত্ববিশারদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, তা ছিল কল্পনার অতীত। ‘হেরিটেজ অব বেঙ্গল’ শিরোনামে গবেষণা করেছেন পশ্চিম বাংলার মন্দিরের টেরাকোটা শিল্প নিয়ে। এছাড়া বাংলার মুসলিম শাসনকালের মুদ্রা গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রাচীন বঙ্গাক্ষর ও ফারসিলিপি তিনি অধ্যয়ন করেছেন সযত্নে। তিনি খুঁজে বের করতে চেয়েছেন বাংলার ইতিহাসের কিছু হারানো অধ্যায়। ভারতে ও বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বশীর যেভাবে সমাদর লাভ করেছেন, তাতে মনে হয় তাঁর শ্রম সার্থক হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি গবেষণা করেছেন ভারতীয় শিল্পকলার সামাজিক পটভূমি নিয়ে, বিশেষত বাংলার পোড়ামাটির শিল্প নিয়ে।
পরম শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীর গুছিয়ে কথা বলতেন। সময়ানুবর্তিতা মেনে চলতেন। সভা সমিতিতে যেতে বা ফিতা কাটতে পছন্দ করতেন না। বক্তৃতা দিতে চাইতেন না। কিন্তু যখনই বক্তব্য রেখেছেন, চমৎকার ভাষাশৈলী ও অসাধারণ উপস্থাপনায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছেন শ্রোতারা। আমার শ্বশুর শ্রদ্ধাভাজন মুর্তজা বশীর একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। আমার শাশুড়ির কাছে তিনি ছিলেন প্রেমময় যত্নবান ¯স্বামী, আমার স্ত্রী’র কাছে তিনি মহান পিতা। আমার সন্তানদের কাছে তিনি নানা হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ। দেশের মানুষের কাছে তিনি বরেণ্য ব্যক্তি। সর্বোপরি, শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীর একজন চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নীতিবান মানুষ। তাঁর ছিল না কোন অপ্রাপ্তি। একজন সফল ও সার্থক পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণা।
জন্মগত প্রতিভায় বিশ্বাসী ছিলেন না মুর্তজা বশীর। প্রচুর পরিশ্রম করতেন। কাজ করার আগে, ছবি আঁকায় কিংবা লেখার আগে প্রচুর পড়ালেখা করতেন অনুশীলন করতেন। তাই সবার থেকে তিনি আলাদা। মৃত্যুও পর তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম নিশ্চয়ই বশীরকে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি বলতেন, তিনি পাখি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর ডানা ছিল না। অন্তিম বিচারে শিল্পী মুর্তজা বশীর রেনেসাঁর মানসপুত্র হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকবেন, যার শিল্পীসত্তার শেঁকড় দেশের মাটিতে। শ্রদ্ধেয় মুর্তজা বশীরের প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
– লেখক: কায়েস চৌধুরী, শিল্পীর জামাতা ও ব্যাংকার